লিখেছেনঃ চলনামৃত (তারিখঃ মঙ্গলবার, ২৭/১২/২০১১ - ১৮:৩৪)
সভ্যতার পথে মহাযাত্রা
মানুষের উদ্ভব বা সৃষ্টি নিয়ে মানবজাতির কৌতুহল এবং ভাবনার অন্ত নেই, এবং এই কৌতুহল ও ভাবনা সুপ্রচীন। স্বভাবতঃই এ সংক্রান্ত সমাধান সূত্রে ধর্মসমূহের এক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। হিন্দু বা সনাতন ধর্ম অনুযায়ী নিদ্রিষ্টভাবে কে কখন কিভাবে মানুষ সৃষ্টি করেছে, ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো-প্যাঁচানো, জটিল। বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে জটিলতা আরও এক ধাপ উপরে, বুদ্ধত্ব লাভ করার আগে সেটা জানার কোন উপায় নেই। তুলনায় ইসলাম তথা সেমেটিক ধর্মগুলোয় ব্যাপারটা সরল, ঈশ্বর আদম আর ঈভকে সৃষ্টি করেছেন, ঘটনাক্রমে তাদের মিলন ঘটেছে, তাদের সন্তান সন্ততি হয়েছে, সেই থেকে শাখা প্রশাখার মত মানবজাতির উদ্ভব।
এখন বিজ্ঞানীরাও (প্রধানতঃ জেনেটিক বিজ্ঞানীরা) সে পথেই হাটছেন, তাঁরা বলছেন বর্তমান মানব সমাজের একজন আদি মাতা বা ঈভ ছিলেন, একজন আদি পিতা বা আদমও ছিলেন। কিন্তু রুপবান কন্যার কাহিনীর মত এখানে ব্যাপক একটা ট্রাজেডিও আছে, সেই আদমের চেয়ে ঈভ বয়সে বড়, বার চোদ্দ বছরের বড় না, হাজার হাজার বছরের বড়। বস্তুতঃ তাদের মধ্যে কষ্মিনকালেও দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। তাহলে কেমনে কি? আসলে তাঁরা হলেন মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ এবং ওয়াই ক্রোমোজমাল আদম। বর্তমান মানব সমাজের সকল মানুষ জেনেটিক্যালি তথাকথিত এই ঈভ এবং আদমের ডিএনএ ধারন, বহন এবং পরিবহন করে চলেছে। তাদের উদ্ভব ঘটেছিল পূর্ব আফ্রিকায়, কিন্তু সেখান থেকে আমাদের স্বল্প কিছু পূর্বপুরুষদের(অবশ্যই কিছুসংখ্যক নারীও ছিলেন) আফ্রিকার বাইরে বিশ্বমূখী এক অবিস্মরনীয় এক মহাযাত্রার কারনেই উদ্ভব ঘটেছে বর্তমান কালের অতি উন্নত সুসভ্য মানবগোষ্ঠীর। এই যুগান্তকারী অবিস্মরনীয় মহাযাত্রার তত্বটি "আউট অব আফ্রিকা" তত্ব নামে সুপ্রশিদ্ধি লাভ করেছে। পুরো বিষয়টা আমাদের মত সাধারন পাঠকদের বোঝার জন্য কিছুটা জটিল, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
মানবদেহের কোষ সমূহ দুই ধরনের ডিএনএ ধারন করে, নিউক্লিয়াসের ডিএনএ এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। নিউক্লয়াসের ডিএনএ সমূহ শরীরের প্রায় সকল কাজকর্মের জন্য নিযুক্ত, তাদের সংখ্যাও বিপুল, প্রায় সত্তর হাজার। অপরপক্ষে মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ সমূহের উল্লেখযোগ্য কোন কাজ নেই এবং সংখ্যায়ও তারা অতি অল্প, মাত্র সাঁইত্রিশটি। তবে কোষ তথা দেহে শক্তি সঞ্চালনের ক্ষেত্রে মাইটোকন্ড্রয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পাল করে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ক্ষেত্রে মাইট্রকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুধুমাত্র মাতৃধারায় বাহিত হয়, অর্থাৎ মানুষ (পুরুষ কিংবা নারী) তার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ গুলো শুধুমাত্র তার মায়ের কাছ থেকেই পেতে পারে। বর্তমানে জীবিত প্রতিটি নারী তার মাইটোকন্ড্রিয়াটি তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন এবং তিনি তা তার পুত্র-কন্যাদের মাঝে পরিবাহিত করবেন। যদি আমরা এক প্রজন্ম পিছিয়ে যাই, তাহলে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা নিশ্চিতরুপেই কম হবে, কারন সেই প্রজন্মের অনেক নারী কন্যা সন্তানের জন্ম দেন নি, অনেকে কোন সন্তানই জন্ম দেন নি। যদি আমরা আরও একটি প্রজন্মে পিছিয়ে যাই, তাহলে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা আরও কমে আসবে, এভাবে প্রতিটি পূর্ব প্রজন্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি কমতেই থাকবে। এভাবে কমতে কমতে একসময় আমরা শুধু একজন মাত্র নারীতে গিয়ে পৌঁছবো, মাইটোকন্ড্রিয়ার হিসেবে যিনি হলেন আমাদের আদি মাতা বা মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ। তিনি কতদিন আগে জীবিত ছিলেন তা নির্ধারনের জন্য প্রথমে সকল অঞ্চলের সকল জাতির সকল গোত্রের নারীদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষন করে এগুলোকে নানা শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছে। উদাহরন স্বরুপ মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ কে L শ্রেনীভূক্ত ধরে নিলে মিউটেশনের মাধ্যমে তার পরবর্তী প্রজন্ম গোত্রের ডিএনএ Lo শ্রেনীভূক্ত, এইভাবে L1, L2, L3, L4, L5, এবং L6। এদের মধ্যে L3 ডিএনএ থেকে M শ্রেনীভূক্ত নতুন একটি ডিএনএ গোত্রের উদ্ভব হয় এবং তারা মধ্য থেকে একদল মানুষ আফ্রিকার বাইরে চলে আসে। পরে মিউটেশনের মাধ্যমে M থেকে N এবং এবং এই দুটি শ্রেনী থেকে আরও নানা উপশ্রেনীর সৃষ্টি হয়। আফ্রিকায় ইথিওপিয়া এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকটি অঞ্চলে ২০% পর্যন্ত নারীর মাইটোকন্ড্রিয়া M শ্রেনীভূক্ত। আফ্রিকার বাইরে সকল মানুষের মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ M কিংবা N শ্রেনীর বিভিন্ন উপগোত্র কিংবা তা থেকে উদ্ভুত, কিন্তু আফ্রিকার বাইরে L শ্রেনীর কোন অস্তিত্ব নেই। স্বভাবতঃই Lo গোত্রভূক্ত ডিএনএ থেকে আফ্রিকার বাইরেরর বর্তমানের কোন গোত্রের নারীর ডিএনএ তে অনেক পার্থক্য রয়েছে, মূলতঃ মিউটেশনের মাধ্যমে বিবর্তনই এই পার্থক্যের কারন। এই মিউটেশন সমূহ সংঘটিত হওয়ার সময় বিশ্লেষন করে বিজ্ঞানীগন L প্যাটার্নধারী মানবী অর্থাৎ মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভের জীবনকাল নির্ধারন করেছেন। সময়টি মোটামুটি এখন থেকে দেড়-দু লক্ষ বছর আগে।
আমাদের আদি মাতার বংশ লতিকার বিস্তারন
একইভাবে ওয়াই ক্রোমোজমে মিউটেশনের বিশ্লেষন করে বিজ্ঞানীরা ওয়াই ক্রোমোজম ভিত্তিক আদি পুরুষের সন্ধান বের করতে সক্ষম হয়েছেন, তারঁ বিচরণের বসময়কালটি পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার বছর আগের একটি সময়। আমরা জানি মানব জন্মের ক্ষেত্রে ওয়াই ক্রোমোজম শুধুমাত্র পিতৃধারায় প্রবাহিত হয়। প্রতিটি মানুষের(পুরুষ কিংবা নারী) দেহকোষের নিউক্লিয়াসে যে ৪৬টি ক্রোমোজমের অস্তিত্ব রয়েছে, তার একটি হলো ওয়াই ক্রোমোজম, আর এই ওয়াই ক্রোমোজমটি শুধুমাত্র তার বাবার দেহ থেকেই আসে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ওয়াই ক্রোমোজমের মিউটেশনের ভিন্নতা পর্যবেক্ষন করে সহজেই প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর বিচরণস্থল শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্রের এবং আফ্রিকার বাইরের মানবজাতির বিভিন্ন গোত্রে ওয়াই ক্রোমোজমের ডিএনএ তে তাৎপর্যপুর্ন ভিন্নতা লক্ষনীয়।
এই কার্যকরনের উপর ভিত্তি করে রেবেকা ক্যান, মার্ক ষ্টোনকিং এবং সি এ্যালান ১৯৮৭ সালের জানুয়ারী সংখ্যা নেচার পত্রিকায় এক বিস্ফোরক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তাঁরা ঘোষনা দেন, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর মিউটেশন বৈচিত্র বিশ্লেষন করে তাঁরা এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন যে এখনকার সকল মানুষের একজন নিকটতম একক নারী প্রজন্মের অস্তিত্ত ছিল এবং তার অবস্থিতির সময়কাল নির্ধারন করতে পেরেছেন। তিনি কমবেশী দেড় থেকে দু লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রকার কোন এক স্থানে বাস করতেন। এই পরীক্ষার জন্য তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ১৪৫ জন গর্ভবতী নারীর প্লাসেন্টা থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া নিয়ে তা বিশ্লেষন করেন। এঁদের মধ্যে বিশ জন আফ্রিকান, ৪৬ জন ককেশিয়, ৩৪ জন এশীয়, ২১ জন আদিবাসী অষ্ট্রেলীয় এবং ২৬ জন আদিবাসী নিউ গিনির নারী। গবেষনার ফলাফল পরিস্কার নির্দেশ করে আফ্রিকার সাতজনের একটি দল তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে পুরনো ডিএনএ বহন করছে। আফ্রিকার বাকী নারীগন, অষ্ট্রেলীয় ও নিউ গিনির আদিবাসী এবং এশীয় ও ককেশিয়দের নারীদের ডিএনএতে এই সাতজনের চেয়ে মিউটেশনের সংখ্যা বিভিন্ন সংখ্যায় বেশী এবং মিউটেশনের প্রকৃতিও বিভিন্নমূখী। পরবর্তীতে অবশ্য এ নিয়ে আরো বহু গবেষনা হয়েছে এবং মিউটেশনের ধরন এবং সংখ্যা নিরুপন করে বিভিন্ন মানব জাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিচরন কালও এই সকল বিশ্লেষনের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়েছে।
উন্মেষকালের প্রজন্ম
মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভের ডিএনএ বহনকারী একজন নারীর সংগে বহু সহস্র বছর পরে ওয়াই ক্রোমোজমাল আদমের মিলনের ফলে একটি নতুন বংশগতির সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল ইথিওপিয়ার সাভানা ভূমিতে, এরাই হলো বর্তমান আধুনিক মানুষদের আদি প্রজাতি। এরা সময়ের বিবর্তনে এবং পারিপার্শ্বিক কারনে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শারীরিক গঠন অনুয়ায়ী এরা ছিল অতীতের যে কোন হোমিনিডদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর। বিশেষতঃ তাদের মস্তিস্কের আকার ছিল প্রায় এখনকার মানুষদের সমান। প্রকৃতি এবং সমসাময়িক বিভিন্ন প্রানীকূল থেকে উদ্ভূত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার মত শারীরিক কুশলতা এবং চিন্তার সক্ষমতা তাদের অনেক বেশী ছিল। তাদের এই উৎকর্ষতা আরও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে তাদের স্থানান্তরে গমন এবং নয়া পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং কুশলতার কারনে। মূলতঃ এমনই এক অবিস্মরনীয় স্থানান্তরিক যাত্রাই সৃষ্টি করেছে বর্তমানের এ যুগের সর্বশ্রেষ্ট প্রানী, মানবকূল।
এদের মধ্যে একটি দল কঙ্গোর উষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চলে অভিগমন করে এবং কঙ্গোয়েড প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়। অন্য একটি দল পূর্ব আফ্রিকাতেই থেকে যায়, যারা খইসানিড বা সান-বুসান প্রজাতির উদ্ভব ঘটায়, অন্য আর একটি দল উত্তরে লোহিত সাগরের তটরেখার দিকে চলে যায় এবং লোহিত সাহর পার হয়ে ল্যাভেন্ট হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্র তটরেখা ধরে পারস্য উপসাগরের দিকে চলে আসে। এই স্থানে এই মানবগোষ্ঠী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে, অন্যদল সেখানেই জাগ্রোজ উপত্যকায় থিতু হয়। চলমান দলটি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া বরাবর চলে আসে, তারপর তাদের একাংশ আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে আটষট্টি হাজার আগে চীন অবধি পৌঁছে যায়। অন্য দলটি সেখানেই ভারত-থাইল্যান্ড-মিয়ানমার অঞ্চলে বসতি গড়ে এবং তাদের মধ্য থেকে ক্রমে ক্রমে প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েড প্রজাতির উদ্ভব ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে তারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপমালা হয়ে সাতাত্তর হাজার বছর আগে নিউ গায়ানা এবং ৬৫ হাজার বছর আগে অষ্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে। অপর দিকে অন্য একটি অংশ আফ্রিকা থেকে আগমনকালের আদি বৈশিষ্ট ধারন করে নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী হিসেবে একই অঞ্চলে বিস্তারিত হতে থাকে।
পারস্যের জাগ্রোজ উপত্যকায় অবস্থানকালে
পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্ব সময়কালে ইরানে অবস্থিত মানুষেরা প্রোটো ককেশয়েড মহাজাতির সৃষ্টি করে উত্তর-পশ্চিম দিকে মধ্য এশিয়া হয়ে ৪৫ হাজার বছর পূর্ব সময়কালরাশিয়া এবং পশ্চিম সাইবেরিয়ার স্তেপস অঞ্চলে পৌঁছে। অপর একটি দল প্রথমে ল্যাভেন্ট এবং সেখান থেকে আনাতোলিয়া(তুরস্ক), সেখান থেকে বলকান অঞ্চল হয়ে ইউরোপের দক্ষিন পর্যন্ত বিস্তারিত হয়ে ৪৩ হাজার বছর পূর্ব সময়কালে অরিগনেশিয়ান সভ্যতার সূচনা ঘটায়। রাশিয়া থেকে তারা পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে ৩৩ হাজার বছর পূর্ব সময়কালে গ্রাভেট্টিয়ান সভ্যতার উদ্ভব ঘটায়। উল্লেখ্য যে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে আধুনিক মানুষদের আগমনে পূর্ব থেকেই হোমো নিয়ান্ডার্থাল গোষ্ঠীর ভিন্ন জাতের হোমিনিডরা বসবাস করে আসছিল, তারাও উন্নত সভ্যতার অধীকারী ছিল, তাদের সংগে ককেশয়েডদের দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকার সংগ্রাম চলে এবং প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে তারা মানুষের কাছে চুরান্ত হার মেনে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ল্যাভেন্ট অঞ্চল থেকে আর একটি দল উত্তর অফ্রিকায় মিশর, লিবিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোর দিকে ছড়িয়ে পরে। একই সময়কালে ইন্দোচীন এবং দক্ষিন চীনে প্রোটো মঙ্গোলয়েড প্রজাতির সৃষ্টি হয় এবং তাদের অনেকে পশ্চিম দিকে পূর্ব সাইবেরিয়ার স্তেপস অবধি চলে যায়, এভাবে উত্তর এবং দক্ষিন মঙ্গোলয়েড নামে পৃথক দুটি উপ প্রজাতির সৃষ্টি হয়। উত্তর মঙ্গোলয়েডদের একটি দল উত্তর পশ্চিম দিকে সাইবেরিয়া এবং আলাস্কার মধ্যবর্তী বেরিঙ্গিয়া অবধি চলে যায় এবং সেখান থেকে আলাস্কা হয়ে উত্তর আমেরিকার মহাদেশের তটরেখা ধরে দক্ষিনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
মহাযাত্রায় পথে পথে
ত্রিশ হাজার বছর পূর্বকালের মধ্যে বিবর্তনের বিভিন্নমূখী ধারায় মানব প্রজাতি ছয়টি প্রধান শাখায় বা মহা জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, একটি বাদে তাদের বাকী সবাই এখনও স্ব স্ব অস্তিত্ব বজায় রেখে নতুন নতুন জাতি উপজাতি সৃষ্টি করে চলেছে।
শাখাগুলো হলো-
১. পশ্চিম আফ্রিকায় কঙ্গোয়েড মহাজাতি
২. পূর্ব ও দক্ষিন আফ্রিকায় ক্যাপয়েড মহাজাতি(পরবর্তীতে পূর্ব আফ্রিকার কঙ্গোয়েড মহাজাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়)
৩. ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউ গায়ানা, এবং অষ্ট্রেলিয়া এবং ক্রান্তিয় দ্বীপসমূহে অস্ট্রালয়েড মহাজাতি
৪. অষ্ট্রালয়েড মহাজাতি অধ্যুষিত অধিকাংশ অঞ্চলে নেগ্রিটো মহাজাতি
৫. পূর্ব এশীয়া, সাইবেরিয়া এবং আমেরিকায় মঙ্গোলয়েড মহাজাতি এবং
৬. ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ায় ককেশয়েড মহাজাতি।
এই প্রজাতিসমূহেও বিবর্তনগত বিভাজনের ধারা অব্যাহত থাকে এবং নতুন নতুন জাতিসত্বার উদ্ভব হতে থাকে।
মহাযাত্রার চরনচিহ্ন
প্রায় ২০ হাজার বছর পূর্বকালে যখন সারা বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ, সর্বশেষ বরফযুগের অভ্যুদয় ঘটে, এই ঘটনা উত্তর ইউরোপের মানুষদের দক্ষিনে তাড়িত করে, তারা দক্ষিন ফ্রান্স, উত্তর স্পেন, ইউক্রেন এবং বলকান অঞ্চলে পারি জমায়। অপরদিকে ততদিনে সম্পূর্ন বিকশিত সাইবেরিয়ার উত্তর মঙ্গোলয়েড প্রজাতি দক্ষিনে দক্ষিন চীনের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। প্রাকৃতিক বৈরীতার কারনে এই উভয় সংখ্যক মানুষেরই ব্যাপক বিনাশ ঘটে। দক্ষিন মঙ্গোলয়েডদের কিছু অংশ মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশীয়া গিয়ে সেখানের নেগ্রিটো মহাজাতির বিভিন্ন প্রজাতিকে সংহারের মাধ্যমে বিলোপ ঘটায় এবং অষ্ট্রালয়েডদের কিছুটা বিলোপ, কিছুটা তাদের সাথে সংমিশ্রিত হয়। ভারত, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং তৎসন্নিহিত এলাকায় নেগ্রিটো প্রজাতি ব্যাপকভাবে অষ্ট্রালয়েড এবং মঙ্গোলয়েড মহাজাতির বিভিন্ন প্রজাতির প্রবল নিষ্পেষনে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়, সামান্য পরিমানে সংমিশ্রনও ঘটে। তবুও ভারতে মোটামুটিভাবে অনেকদিন তারা টিকে ছিল, কিন্তু আর্যদের আগমনের পর তাদের রাক্ষস খোক্কস হিসেবে চিন্হিত করে তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অসংখ্য অভিযান চালিয়ে তাদের প্রায় সম্পূর্নরুপে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। এখন বিচ্ছিন্নভাবে শুধুমাত্র আন্দামান, ভারতের ইরলা, থাইল্যান্ডে মানি, মালয়েশিয়ায় সেমাং, ফিলিপাইনে আয়েটা এবং মিয়ানমারে কিনতাং প্রভৃতি নেগ্রিটো প্রজাতির উপজাতিসমূহ নামেমাত্র টিকে আছে।
মঙ্গোলয়েড সভ্যতার বিকাশ
যখন বরফযুগের অবসান ঘটতে থাকে(১৫ হাজার বছর পূর্বে), এই সকল উদ্বাস্তু জনগন আবার উত্তর দিকে অভিগমন করে। এসময় স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বকালে প্রথম মানব বসতি স্থাপিত হয় এবং পৃথিবীর মানবসংখ্যা প্রায় এক কোটিতে উন্নীত হয়। নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয় এবং চীন ও মধ্যপ্রাচ্যে, (সম্ভবতঃ ভারতেও) প্রাথমিক কৃষি যুগেরও সূচনা ঘটে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে। ইউরোপের ৮০% মানুষই পুরাতন প্রস্তর যুগে সেখানে অভিবাসনকারী, বরফ যুগের পাঁচহাজার বছর ইউরোপের দক্ষিনাঞ্চলে বসবাস করার পর পুনরায় তারা উত্তরের অঞ্চলগুলিতে ফিরে যায় এবং বংশ বিস্তার করতে থাকে, বাকী ২০% মানুষ নব্য প্রস্তর যুগে, প্রায় ৮ হাজার বছর আগে আনাতোলিয়া থেকে দক্ষিন ইউরোপ এবং ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলে অভিগমন করে। এই সকল মানব বিচর মানুষের স্থানান্তরের চেয়ে বরং কৃষি ও সংস্কৃতির বিস্তার ও বিকাশ ঘটাতেই বেশী ভূমিকা রাখে।
সভ্যতার আরও বিকাশ
একসময় অনেক বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিল পূর্বতন প্রজাতিসমূহ থেকে বিভিন্ন স্থানে আলাদা আলাদা ভাবে আধুনিক মানুষদের(হোমো সেপিয়েন্স) বিভিন্ন প্রজাতির (রেস) উদ্ভব হয়েছে, পিকিং ম্যান এবং জাভা ম্যান এর অনেকগুলো ফসিল আবিস্কৃত হওয়ার ফলে(এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে এইগুলি আমাদের পূর্বতন হোমিনিড হোমো ইরেক্টাসদের ফসিল) এইরুপ ধারনা দৃঢ় হয়েছিল। বিশেষ করে জাত্যাভিমানী চীনাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে তারা আলাদা ভাবে ভিন্নতর পূর্ব প্রজাতি থেকে বিকষিত হয়েছে। এই বিশ্বাস সেখানে সর্বস্তরে এতই দৃঢ় যে স্কুলের নিম্নপর্যায় থেকে এই মতবাদ তাদের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত। জেনেটিক প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে আউট অব আফ্রিকা তত্ব সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে ২০০১ সালে সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক বিজ্ঞানী জিন লী সেই তত্বটিকে ভ্রান্ত প্রমানিত করার জন্য বিশাল এক উদ্যোগ গ্রহন করেন। তিনি চীন এবং দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার ১৬০ টি মানব গোষ্ঠী থেকে ১২ হাজার মানুষের ওয়াই ক্রোমোজমাল ডিএনএ সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যাবস্থা করেন। ফলাফল বিশ্লেষন করে অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ করেন এর মধ্যে একটি ডিএনএ ও আফ্রিকার ওয়াই ক্রোমোজমাল এ্যাডামের আদি ডিএনএ থেকে আলাদা নয়। অবশেষে তিনি আনন্দের সাথে স্বীকার করে নেন, বিশ্বের সকল মানবগোষ্ঠী একই উৎস থেকে উদ্ভূত এবং আমরা সবাই পরস্পরের রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়।
পারিবারিক বন্ধনরেখা
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আজ থেকে বহু সহস্র বছর পূর্বে ইথিওপিয়ার তৃনভূমিতে উদ্ভূত কয়েক হাজার মানুষ যদি সেখান থেকে বিভিন্ন দিকে, বিশেষতঃ তাদের বড় অংশটি আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ার দিকে অভিগমন না করতেন বা করতে সক্ষম না হতেন, তাহলে হয়তো বর্তমানের অতি আধুনিক এই মানবগোষ্ঠীর উদ্ভবই ঘটতো না। কিছুটা উন্নততর এপ বা হোমিনিড হয়ে এখনও বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হতো, অথবা প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলুপ্ত হয়ে ফসিলে পরিনত হয়ে পরবর্তী কোন উন্নত প্রজাতির গবেষনার বিষয়বস্তু হতে অপেক্ষা করতে হতো।
মাইটোকন্ড্রিয়াল হ্যাপলোগ্রুপ অনুযায়ী বিস্তারন
টীকাঃ আউট অব আফ্রিকার সূচনা কাল নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। ডিএনএ তে মিউটেশন কার্যটি কতদিন পর পর ঘটে সে নিয়ে মতভেদের কারনেই এই মতান্তর। মাইটোকন্ড্রিয়াল মিউটেশন অবশ্য শারীরিক কোন পরিবর্তনের কারনে ঘটে না, মূলত এটি একটি iকপিজনিত ত্রুটিমাত্র। সাধারনতঃ মায়ের ডিএনএগুলো হুবহু কপি হয়ে তার কন্যার শরীরে বাহিত হয়, কোন কোন সময় এই কপিতে প্রমাদ ঘটে, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর ক্ষেত্রে সেটাই মিউটেশন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েনস্দের সুদৃঢ় বিস্তারের কারনেই হয়তো অন্য হোমিনিডরা পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment