Wednesday, March 8, 2017

প্রাচীন ভারত উপমহাদেশের কথা: পর্ব-১


প্রাচীন ভারত উপমহাদেশের কথা: পর্ব-১ (খ্রীঃপূঃ ৬ মিলিয়ন বছর আগে থেকে খ্রীঃপূঃ ৩,০০০ বছর পর্যন্ত)
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৯/০৯/২০১২ - ৭:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি: শিক্ষা সববয়সী
ভূমিকা: বর্তমানে ভারত উপমহাদেশে বিরাজমান সংস্কৃতির মতই এর ইতিহাসও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। সময়ের পথ ধরে, ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে অখণ্ড ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক কালের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহ। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বিদেশী শক্তির আগ্রাসন, পরাধীনতা ও সাম্রাজ্যবাদ। মূলত ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পরে থেকেই এই উপমহাদেশ বিদেশী শাসকদের অধীনে চলে যায়। প্রথমে মুঘলরা এবং পরে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে রাজত্ব করে। একথা বলার উপায় নেই যে, ১২০০ শতকের পূর্বে এই উপমহাদেশ পরাশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু তখন পর্যন্তও এই উপমহাদেশের শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে আসা পারস্য ও গ্রীক আক্রমণ ঠেকিয়ে নিজেদের দেশ নিজেরাই শাসন করেছেন। এখানে মূলত ১২০০ শতকের পূর্ববর্তী সময়ের (যা এখানে ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনকাল হিসেবে ধরা হয়েছে) ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই পর্বে ভারত উপমহাদেশে প্রথম মানুষের আবির্ভাব থেকে শুরু করে নব্য-প্রস্তর যুগ পর্যন্ত সময়কাল নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই সময়ের ইতিহাস রচিত হয়েছে মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক গন ও জীবাশ্ম-বিদ গনের হাতে। অনেক বিষয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে ভারত উপমহাদেশে মানুষের আবির্ভাব এবং মানব সভ্যতার বিকাশ নিয়ে একটা মোটা দাগের ধারণা পাওয়া যায়। এই রচনার মূল উদ্দেশ্য, সাধারণ পাঠকের কাছে প্রাচীন ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কিত এই মোটা দাগের ধারণাটি আরও মোটা দাগে পৌঁছে দেওয়া।
[বিঃদ্রঃ আমি ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্বের লোক নই, কিন্তু দুটোই আমাকে সমান ভাবে আকর্ষণ করে। এই রচনাটি তৈরি করেছি, “India: The Ancient Past, A history of the Indian sub-continent from c. 7000 BC to AD 1200 -by Burjor Avari” এই বইটির উপর ভিত্তি করে। আমার জানা ও বুঝায় ভুল থাকা খুবই স্বাভাবিক, কাজেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবেত্তা পাঠকের কাছে অনুরোধ থাকবে, কোনও অসঙ্গতি নজরে এলে সেটা দয়া করে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং শুধরে দিবেন]

আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশে মানুষের আগমন:
আজ থেকে প্রায় ৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে বিবর্তনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। এই সময়ে আফ্রিকাতে সর্বপ্রথম চতুষ্পদী প্রাইমেট থেকে দ্বিপদী আদি-মানবের আবির্ভাব ঘটে। জীবাশ্ম-বিদেরা এই দ্বিপদী আদি-মানবদের হোমিনিন নামে অভিহিত করে থাকেন। প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রজাতির হোমিনিনেরা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বিচরণ করত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ২.৫ মিলিয়ন বছরের পূর্ববর্তী সময়ে এইসকল হোমিনিনেরা কোনও হাতিয়ারের ব্যবহার শিখছিল বলে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাপ্ত জীবাশ্ম অনুযায়ী এটা ধারণা করা হয় যে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে সর্বপ্রথম হোমিনিনেরা পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করা শুরু করে। এই সময়ে হোমিনিনেরা মূলত হোমো হেবিলিস, হোমো এরগ্যাস্টার ও হোমো ইরেক্টাস এই তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। আরও পরে, প্রায় ১ মিলিয়ন বছর পূর্বে হোমো এরগ্যস্টার ও হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির হোমিনিডেরা আফ্রিকার বাইরে ইউরোপ, ও এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে।
হোমো গোত্রের এইসকল প্রজাতিরা প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে পাথরের হাতিয়ারের ব্যবহার শিখলেও সর্বপ্রথম পরিপূর্ণ মানব বা আধুনিক মানুষের (হোমো সেপিয়েন্স) আবির্ভাব ঘটে মাত্র ৪ লক্ষ বছর পূর্বে। এই সময়ে হোমো ইরেক্টাস ও তার থেকে বিবর্তিত হোমো সেপিয়েন্স উভয়েই পৃথিবীব্যাপী সহাবস্থান করে। হোমো সেপিয়েন্সের উৎপত্তি-কাল নিয়ে মতানৈক্য না থাকলেও এদের উৎপত্তিস্থল নিয়ে দ্বিমত আছে। একদলের মতে এরা প্রায় কাছাকাছি সময়ে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়া হোমো ইরেক্টাস থেকে বিবর্তিত হয়, অন্য দলের মতে এরা মূলত আফ্রিকাতে হোমো ইরেক্টাস থেকে বিবর্তিত হয় ও পরবর্তীতে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যাইহোক, ধারণা করা হয় যে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম আধুনিক মানুষের আগমন ঘটে মাত্র ৩০ হাজার বছর পূর্বে। এরা আফ্রিকা থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। কেউ কেউ মনে করেন প্রায় ৫০ হাজার বছর পূর্বে নৌপথে দক্ষিণ ভারতে সর্বপ্রথম আধুনিক মানুষের আগমন ঘটে থাকতে পারে।
আধুনিক মানুষের ইতিহাস ৩০-৫০ হাজার বছরের পুরনো হলেও এই উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের সূচনা হয় প্রায় ৫ লক্ষ বছর পূর্বে যখন পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারকারী হোমো ইরেক্টাসরা এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম বসবাস শুরু করে (আফ্রিকাতে প্রস্তর যুগের সূচনা হয় ২.৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে)। উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে পর্যন্ত যখন সর্বপ্রথম হরপ্পাতে তামার প্রচলন শুরু হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রস্তর যুগের এই দীর্ঘ ব্যাপ্তিকালকে আলোচনার সুবিধার্থে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আদি-প্রস্তর যুগ, মধ্য-প্রস্তর যুগ ও নব্য-প্রস্তর যুগ এই তিনটি উপ-ভাগে বিভক্ত করেছেন। এখানেও উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের ইতিহাসকে এই তিনটি উপ-ভাগে আলাদা-আলাদা ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

আদি-প্রস্তর যুগ: উপমহাদেশে আদি প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৬,০০০ বছর পর্যন্ত। এই যুগের প্রধান হাতিয়ার ছিল নুড়ি পাথরের ধারালো কাটালি আর পাথরের তৈরি একধরনের হাত কুঠার। পাকিস্তানের সন নদীর উপত্যকায় বিস্তর এলাকা জুড়ে নুড়ি পাথরের কাটালির স্তর পাওয়া গেছে। আর হাত কুঠারের সন্ধান পাওয়া গেছে মাদ্রাজের চেন্নাইয়ে। আদি প্রস্তর যুগের হাতিয়ার আর ফসিল গুলো থেকে এটা ধারনা করা যায় যে ঐ যুগের মানুষেরা ছিল মূলত শিকারি ও সংগ্রহকারী। তারা মূলত পশু শিকার, আর বুনো ফলমূল, শিকড়-বাকড়, ইত্যাদি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা মূলত যাযাবরের মত খোলা জায়গায় বসবাস করলেও কখনও কখনও নিরাপত্তার জন্য গুহায় আশ্রয় নিত। মধ্য ভারতের নর্মদা নদীতীরের গুহা চিত্রগুলো এমনটিই ইঙ্গিত করে। অল্প কিছু ফসিল, উপরোল্লিখিত হাতিয়ার আর এই গুহাচিত্রগুলো ছাড়া এই যুগের আর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য নমুনা পাওয়া যায়না।

মধ্য-প্রস্তর যুগ: মাইক্রোলিথ নামক একধরনের ছোট আকারের হাতিয়ারের ব্যবহার মধ্য-প্রস্তর যুগকে আদি-প্রস্তর যুগ থেকে আলাদা করেছে। আকারে ছোট হলেও পূর্ববর্তী যুগের যেকোনো হাতিয়ারের চেয়ে মাইক্রোলিথ ছিল উৎকৃষ্ট-মানের ও অধিক কার্যকরী। এগুলো ছিল আকারে খুবই ছোট (লম্বায় এক সেঃমিঃ বা একটু বেশি আর পাশে প্রায় তার অর্ধেক) আর নানা আকৃতির (ব্লেডের মত চ্যাপ্টা, ত্রিকোণাকৃতির, ট্রাপিজিয়ামাকৃতির, অর্ধচন্দ্রাকৃতির, তিরের অগ্রভাগের মত সূচালো ইত্যাদি)। এই হাতিয়ার তৈরিতে প্রয়োজন হত কোয়ার্টজ, ফ্লিন্ট বা চেলসিডোনির মত শক্ত পাথরের। নদী অববাহিকায় প্রাপ্ত নুড়ি সমূহ ছিল এই সকল হাতিয়ারের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। কাজেই পাথরের খোঁজে মধ্য-প্রস্তর যুগের মানবেরা নদী অববাহিকা ছেড়ে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। আবার আবহাওয়ার বৈরিতার কারণে মধ্য-প্রস্তর যুগের মানুষের মধ্যে ঋতু ভিত্তিক আবাস্থল পরিবর্তনও লক্ষণীয়। সাধারণত শীতকালে এরা গঙ্গা অববাহিকা থেকে মধ্য ভারতের বিন্ধা পার্বত্যাঞ্চলের দিকে চলে যেত এবং গুহায় আশ্রয় নিত আর গ্রীষ্মকালে পুনরায় নদী অববাহিকায় ফেরত আসত। পাথরের তৈরি একধরনের যাঁতাকল ও গোলাকৃতির পাথরের ব্যবহার এই যুগে আদিম কৃষিকাজের সূচনার ইঙ্গিত করে। মানব আবাস্থলের সন্নিকটে প্রাপ্ত গরু, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি পশুর হাড়গোড়ের অবশিষ্টাংশ এই যুগে সর্বপ্রথম পশু-পালনের সূচনারও ইঙ্গিত করে। মধ্য-প্রস্তর যুগে প্রথম মৃতদেহকে কবর দেওয়ার নিদর্শনও পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে এই যুগে মানুষের মধ্যে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি বিশ্বাস ছিল। উপমহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই যুগের নিদর্শন সমূহ পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য স্থান সমূহ হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, বর্তমান ভারতের রাজস্থানের বাগড়, গুজরাটের লানগঞ্জ, গঙ্গা সমভূমির সরাই নহর রাই, মহাদহ ও দমদম এবং মধ্যাঞ্চলের আদমগড়, ভিমবেক্তা ও ঘাগড়িয়া।

নব্য-প্রস্তর যুগ ও কৃষির বিস্তার: প্রায় ১১,০০০ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব) পূর্বে, শেষ বরফ যুগের সমাপ্তির সাথে সাথে মধ্য-প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং নব্য-প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। অনুকূল জলবায়ু ও ভূমির উর্বরতা এই যুগে ব্যাপক ভাবে কৃষির বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা রাখে। তথাপি বরফ যুগের পতনের সাথে সাথেই এই অঞ্চলে কৃষির বিকাশ ঘটেনি কিংবা সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একই সময়ে কৃষির বিকাশ ঘটেনি। ছোট ছোট অঞ্চলে ধীরে ধীরে কৃষির বিস্তার ঘটতে থাকে এবং শিকার-সংগ্রাহক থেকে মানুষজন কৃষকে উন্নীত হতে থাকে। কাজেই প্রায় কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত এই দুই শ্রেণীর মানুষ সহাবস্থান করে। উপমহাদেশের অন্তত ৪-৫ টি অঞ্চলে শিকার-সংগ্রহ থেকে পুরোপুরি কৃষি নির্ভর জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৮,০০০ বছরের দিকে। আবার কোনও কোনও অঞ্চলে এই পরিবর্তন ঘটে মাত্র হাজার বছর পূর্বে।
নব্য-প্রস্তর যুগে সমস্ত উপমহাদেশ জুড়ে মানুষের বসবাস থাকলেও চারটি বিশেষ অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শন সমূহ ঐ যুগের আঞ্চলিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য গুলোকে ধারণ করে। প্রথম অঞ্চলটি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত। বেলুচিস্তানের মেহেরগড়ে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ এই অঞ্চলে প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে কৃষিকাজের সূচনার ইঙ্গিত করে। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাটির তৈরি কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ, বার্লি ও গমের বীজ, ভেড়া ও ছাগলের হাড়, চার্ট এর তৈরি ব্লেড ইত্যাদি। এই সকল নিদর্শন সমূহ পরিষ্কারভাবে কৃষির ইঙ্গিত বহন করে। দ্বিতীয় অঞ্চলটি পাকিস্তানের কাশ্মীর ও সোয়াত উপত্যকায় অবস্থিত। এইখানে কৃষিকাজের ইঙ্গিত বাহি সাধারণ নিদর্শন সমূহ সহ আরও বিশেষ এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে প্রাপ্ত ঘণ্টা-আকৃতির গর্ত সমূহ এই অঞ্চলকে অন্য অঞ্চল সমূহ থেকে আলাদা করেছে। এই গর্তসমূহের ব্যবহারিক দিক নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে। অনেকেই মনে করেন ১৫ ফুট চওড়া ও ১৩ ফুট গভীর এই গর্তগুলোতে সে যুগের মানুষেরা বসবাস করত। তারা এটাও মনে করেন যে এই অঞ্চলের নব্য-প্রস্তর যুগের মানুষেরা মধ্য এশিয়ার গর্ত-বাসী নব্য-প্রস্তর যুগের মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অন্যদিকে, ভিন্ন মতাবলম্বীরা মনে করেন যে এই গর্ত সমূহ শস্য ভাণ্ডার কিংবা আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হত। তৃতীয় অঞ্চলটি পূর্ব ভারতের গঙ্গা অববাহিকায় বিরাট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই অঞ্চলে কৃষির আবির্ভাব ঘটে তুলনামূলক ভাবে অনেক দেরিতে। এখানে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের অনেক নিদর্শনই দেখতে মধ্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শন সমূহের মত। তথাপি এখানকার কোনও কোনও এলাকা যেমন চোপানি মন্দ, মহাগরা, কলদিহাওয়া ও চিন্দ্রাতে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শনসমূহ এইসব এলাকায় প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪,০০০ বছর আগে কৃষির আবির্ভাব হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। এখানে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য শস্যাবশেষ হল ধান, যদিও সেই যুগে ধান চাষ নিয়ে দ্বিমত আছে। অনেকেই মনে করেন এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ধান চাষের আবির্ভাব ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০ বছর এর পরে। নব্য-প্রস্তর যুগের চতুর্থ অঞ্চলটি দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শন সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছাইয়ের স্তূপ। ধারনা করা হয় যে এগুলো এক ধরনের খোয়ারের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ঐ যুগে নির্দিষ্ট ঋতুতে গবাদি পশু পোষ মানানো হত আর ঋতু শেষে সেগুলো আগুনে পোড়ানো হত। অনবরত বছরের পর বছর ধরে একই স্থানে পোড়ানো ছাই গুলো স্তূপাকৃতি ধারণ করে। অঞ্চলভেদে নানা বৈসাদৃশ্য থাকলেও উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে নব্য-প্রস্তর যুগে সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে জীবন-ব্যবস্থা ছিল মূলত কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক। এতদস্বত্বেও একদল নব্য-প্রস্তর যুগীয় মানুষ কৃষি কাজে না গিয়ে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত শিকারি ও সংগ্রাহক হিসেবে বসবাস করে।
কৃষিকাজের আবিষ্কারের সাথে সাথে সেই যুগে মানুষের জীবন ব্যবস্থায় তুমুল বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। সেই যুগের মানুষেরা প্রথমে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে হয়ে, একদল কৃষক, একদল পশুপালক আর একদল শিকারি। হাজার বছর ব্যাপী এই তিন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক ধরনের তৈরি হয় এক ধরনের পরস্পর নির্ভরশীলতা। এক দল আরেক দলের উপর বিভিন্ন উপকরণের জন্য নির্ভর করতে থাকে। যেমন কৃষক চামড়া ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির জন্য পশুপালকের উপর নির্ভর করে তেমনি পশুপালক শস্য ও গোখাদ্যের জন্য কৃষকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কৃষকের ফসল কাটা হয়ে গেলে, পশু পালকেরা সেগুলো গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করত, অন্যদিকে সেই জমিতে গোচারণের ফলে জমা হওয়া গোবর জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে কৃষকের উপকার করত। আবার কৃষক বনজাত দ্রব্যাদি ও মধুর জন্য নির্ভর করত যাযাবর শিকারিদের উপর। এভাবেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন পেশার মানুষের উদ্ভব হতে থাকে। আবির্ভাব ঘটে কারিগর ও বনিক শ্রেণীর। সেই যুগের মানুষ জন যে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট শান্তি পূর্ণ জীবন যাপন করত এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রায়শই দলে-দলে বা গোত্রে গোত্রে মারামারি হানা-হানি হত। এর মূল কারণ অবশ্য ছিল চাষ যোগ্য ভূমি। চাষাবাদের জমি ও ফসল রক্ষার জন্য প্রায়শই কৃষকের সাথে পশুপালক শ্রেণীর যুদ্ধ-বিগ্রহ হত। ভূমির দখল বা মালিকানা রক্ষার নিমিত্তে তৈরি হয় গোত্র ব্যবস্থা। আর স্বাভাবিক ভাবেই গোত্রের সবচেয়ে ব্যক্তিত্বপূর্ন মানুষের হাতে যায় গোত্রের নেতৃত্ব। গোত্র ব্যবস্থা পরবর্তীতে পরিবার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। চালু হয় বিবাহ প্রথার। খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ সালের দিকে হরপ্পান সভ্যতার বিকাশ এর মাধ্যমে নব্য-প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে। পরের পর্বে হরপ্পান সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মাহফুজ খান

No comments:

Post a Comment